৫৭ বছর পর ফিরে এসে শোনেন মা-বাবা মারা গেছে ৩০ বছর আগে
১২ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া আবদুল জলিল ৫৭ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে তার বয়স ৬৯ বছর। তিনি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের স্থলবর্ষা গ্রামের মৃত রমিজ উদ্দিনের ছেলে। আবদুল জলিল সোমবার (২২ নভেম্বর) দীর্ঘ ৫৭ বছর পর নিজ বাড়িতে ফিরেছেন।
রমিজ উদ্দিনের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। আবদুল জলিল ভাইদের মধ্যে মেজো। তার ফিরে আসায় পরিবারের মাঝে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের বন্যা। এলাকার ও আশেপাশের মানুষ প্রতিদিনই ভিড় করছে তাকে দেখার জন্য। এত বছর পর ফিরে আসা যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে।জানা যায়, ১৯৬৫ সালের দিকে ১২ বছর বয়সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। কার সঙ্গে কীভাবে বের হয়েছিলেন, তা জানেন না তিনি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর দেখতে পান তিনি গাজীপুরের টঙ্গী আছেন।
সেখানে তার কাছে থাকা কিছু বই, কাপড়ের ব্যাগ ও ৬০ থেকে ৭০ টাকা ছিনতাইকারী নিয়ে যায়। অসহায় অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর রেলস্টেশনে যান। সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে জামালপুর চলে যান। জামালপুর থেকে আবার ট্রেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশনে নামেন। সেখান থেকে আবার হাঁটতে হাঁটতে ভারতে চলে যান। দুদিন শুধু পানি খেয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকেন। ভারত থেকে আবার বাংলাদেশে চলে আসেন। সেখানে ইপিয়ার (বিজিবি) সদস্য সুবেদার আকবর আলী আবদুল জলিলকে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশনে সৈয়দ আলী মোল্লার হোটেলে খাওয়ায়। হোটেল মালিক তার কথা শুনে তাকে হোটেলে কাজে রেখে দেয়। সেখানে পাঁচ বছর কাজ করেন। তারপর ১৭ বছর বয়সে পাঠানপাড়ার ঘোষ পাতু মিয়া তার মেয়ের সঙ্গে আবদুল জলিলের বিয়ে দিয়ে তার বাড়িতেই থাকতে দেন। তারপর সে শহরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। এর মধ্যে তার ঘরে দুই মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
১৯৮৪ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কামিল আলিয়া মাদরাসায় তিনি নৈশপ্রহরী হিসেবে চাকরি পান। তারপর তিনি রাতে মাদরাসা পাহাড়া দিতেন আর দিনে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। সব সঞ্চয় দিয়ে ১৯৯৭ সালে সোরভনগরে নিজে বাড়ি করেন। ছেলে-মেয়ে বড় হলে তাদের বিয়ে করান। ২০১৮ সালের জুনে তার বড় ছেলের মৃত্যু হয়। ছেলের মৃত্যুর পরের বছর ডিসেম্বর মাসে তার স্ত্রীও মারা যায়। চলতি বছরের আগস্ট মাসে দীর্ঘ ৩৮ বছর চাকরি করে অবসরে যান তিনি। অবসরে যাওয়ার পরে তার মন নিজ গ্রামের বাড়িতে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
তারপর গত সোমবার (২২ নভেম্বর) ট্রেনের টিকেট কেটে টাঙ্গাইল রেল স্টেশনে আসেন। সেখান থেকে ৪০০ টাকায় সিএনজি ভাড়া করে সরাসরি দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নে নিজ গ্রাম স্থলবর্ষায় আসেন। স্থলবর্ষা আসার পর স্থানীয় কানু নামের ব্যক্তিকে তার বাবা-মা, ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। পরে সে তার বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে এসে জানতে পারেন তার মা-বাবা ৩০ বছর আগেই মারা গিয়েছেন। তার বড় ভাইও মারা গিয়েছেন। এখন তার পরিবারে ছোট ভাই ও বোন জীবিত রয়েছে। আবদুল জলিলের ফিরে আসায় তার পরিবারের মধ্যে বইছে আনন্দের বন্যা।
আবদুল জলিলের ছোট ভাই আবদুল কুদ্দুস জানান, আমার ভাই চলে যাওয়ার পর আমার মা দিন রাত ২৪ ঘণ্টা কাঁদছে। মা অভিমান করে বলত, আমি বেঁচে থাকতে তুই এলি না, আমি মরে গেলে যেন কেউ তোকে ঠাঁই না দেয়। মা সবসময় ভাইয়ের কথা বলত। এত বছর পর ভাইকে পাশে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে, তা বলার ভাষা নাই।
আবদুল জলিলের ছোট বোন খাদিজা বেগম জানান, ‘হায়রে জলিল, কি করলিরে জলিল, আয় আমার বুকে আয়’ বলে আমার মা শুধু কাঁদত ভাইয়ের জন্য। নামাজ পড়ে দোয়া করে কাঁদতে কাঁদতে অনেকবার জ্ঞান হারিয়েছে আমার মা। আমার এই ভাইয়ের জন্য আমি লেখাপড়া করতে পারিনি। আমার বয়স যখন আট বছর তখন আমার ভাই চলে যায়। মায়ের সেবা ও দেখাশোনা করতে গিয়ে আর লেখাপড়া হয়নি। আমার বাবা রাতদিন দেশে দেশে ভাইকে খুঁজত। জমি বিক্রি করে করে ভাইকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজত। আমার মা বলতো আমার জমি দিয়ে কী হবে! সব জমি বিক্রি করে দিয়ে আমার জলিলকে খুঁজে আনো। ভাইয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে আমার মায়ের চোখে ঘা হয়ে গিয়েছিল। আমার ভাই আসার পরে আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছুই লাগে না এখন। আমার নিজের সংসার ফালাইয়া আমার ভাইয়ের কাছে আইসা রইছি। গত সোমবার (২২ নভেম্বর) হঠাৎ করে আমার ছেলে ফোন দিয়ে বলল, মা তোমার জন্য সুখবর আছে। তোমার ভাই তো আসছে। আমি আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসি।
আবদুল জলিলের বন্ধু মাইন উদ্দিন জানান, জলিল আমার বাল্যবন্ধু। আমরা ছোট বেলায় একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম। যেদিন জলিল বাড়ি থেকে চলে যায় তার আগের দিনও আমরা বিকেলে বসে এক বিড়ি দুইজনে ভাগ করে খাইছিলাম। জলিল ওইদিন বলছিল আমার তো ভালো লাগতাছে না। আমি চলে যাব। আজ প্রায় ৫৭ বছর পর সেই বন্ধুর সাথে দেখা। কী যে অনুভূতি, তা বলা যাবে না। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে জলিল আমাকে চিনে ফেলে। জলিলের পিঠে একটা কাটা দাগ রয়েছে। আমরা সেটা দেখে ভালোভাবে নিশ্চিত হয়েছি এটাই জলিল।
আবদুল জলিল বলেন, জিন আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে। আমি অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি। আমার বাড়ি আমার পরিবারের কথা আমার সবসময় মনে ছিল। আমি আমার ঠিকানা কখনোই ভুলি নাই। কিন্তু যখনই আমি বাড়ি আসার কথা চিন্তা করতাম তখনই জিন আমাকে যেতে দিত না। বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলে যেতাম। গত চার মাস আগে আমি চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছি। এবার বাড়ি আসার সময় জিন কোনো বাঁধা দেয়নি। ৫৭ বছর পর বাড়ি এসে আমি শুধু আমার ছোট ভাই আর বোনকে জীবিত পেয়েছি। আজ যদি আমার মা-বাবাকে একবার দেখতে পেতাম তবে মরেও শান্তি পেতাম। ভাই-বোনের কাছে জানতে পারলাম আমার জন্য মা-বাবা কত কষ্ট করেছেন। কত চোখের পানি ফেলেছেন। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে ভাই-বোনকে যে দেখতে পেলাম, এটাই আমার পরম শান্তি। আমার পরিবারে এখন প্রায় ২৫ জন সদস্য রয়েছে। আমি তো সবাইকে আমার গ্রামের বাড়িতে আনতে পারব না। তবে আমার ভাই-বোনকে আমার সঙ্গে বেড়াতে নিয়ে যাব। আমার পরিবারও তাদের চাচা ও ফুফুকে দেখতে ব্যাকুল হয়ে আছে।