জিপিএ-৫ পেয়েও কান্না থামছে না হাফসার
লঞ্চে আগুনে মা-বাবা ও ভাই হারানো সেই হাফসা দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে রেজাল্ট পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে হাফসা।
সংসারের বড় মেয়ে হাফসা এ বছর বরগুনা সদর উপজেলার কালীরতবক দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল। পার্শ্ববর্তী উপজেলা বেতাগীর সরিষামুড়ি ইউনিয়নে ঢাকার একটি বায়িং হাউসে কর্মরত পাত্র দেখে রেখেছিলেন হাফসার মা-বাবা।
শুক্রবার উভয়পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছিল হাফসার। সব আনন্দই ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে। হাফসারই এখন দায়িত্ব নিতে হবে ছোট দুই ভাই-বোনের।
জানা যায়, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর গত ৮ দিনেও নিকটাত্মীয় ব্যতীত আর কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের দক্ষিণ বড় লবণগোলা গ্রামের হাকিম শরীফ (৫০) ও পাখি বেগম (৩৫) দম্পতি চার সন্তানকে বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়ির ওপর চাপিয়ে দিয়ে চরম দরিদ্রতার মুখোমুখি হয়ে এক সময় কাজের সন্ধানে আশ্রয় নেন ঢাকা শহরে।
স্ত্রী পাখি বেগম ঢাকার কোনো এক গার্মেন্টসে কর্মসংস্থান খুঁজে নেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি নেন হাকিম শরীফ। স্বামী-স্ত্রীর দুজনের আয়-উপার্জনে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। অনেক স্বপ্ন ছিল এ দম্পতির। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে।
নিজেরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও সন্তানরা কখনই অভাব-অনটনের মুখোমুখি হয়নি। ঢাকার একটি ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা উত্তোলন করে মেয়ে হাফসার বিয়ের কেনাকাটা করতে ২০ ডিসেম্বর আড়াই বছরের শিশুপুত্র নাসিরুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় যান পাখি বেগম। ঢাকাতে বিয়ের কেনাকাটা সেরে ২৩ ডিসেম্বর স্বামী হাকিম শরীফ ও আড়াই বছরের পুত্র নসরুল্লাহকে নিয়ে লঞ্চ অভিযান-১০ এ ওঠেন তারা। সাথে বিয়ের অনেক মালামাল এবং নগদ টাকা থাকায় তারা লঞ্চের স্টাফ কেবিন ভাড়া নেন।
২৩ ডিসেম্বর রাত তিনটার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তাদের সব কিছু শেষ হয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন হাকিম শরীফ, তার স্ত্রী পাখি বেগম এবং তাদের আড়াই বছরের পুত্রসন্তান নসরুল্লাহ।
২৪ ডিসেম্বর সকালে পাখি বেগমের মা ফরিদা বেগম প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারেন লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর। এ দুর্ঘটনার খবর শুনেই শাশুড়ি ফরিদা বেগম অব্যাহতভাবে মোবাইলে ফোন দিতে থাকেন জামাই হাকিম শরীফ ও তার মেয়ে পাখি বেগমকে। বহুবার ফোন করে ব্যর্থ হওয়ার পর রওনা দেন ঘটনাস্থল ঝালকাঠিতে।
সেখানে পৌঁছে অগ্নিকাণ্ডের এ ভয়াবহতা এবং ভস্মীভূত লাশের স্তুপ দেখে মেয়ে-জামাই বা নাতি কাউকেই শনাক্ত করতে পারেননি। ফরিদা বেগমের সাথে খোঁজাখুঁজির কাজে যোগ দেন পাখি বেগমের একমাত্র ভাই নজরুল ইসলাম ও ভগিনীপতি জসীম উদ্দীনসহ স্বজনরা।
নজরুল ইসলাম বলেন, খাওয়া ঘুম হারাম করে একটানা দুই দিন বরিশাল ঝালকাঠি বরগুনা বেতাগীসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজতে থাকেন হাকিম শরীফ, পাখি এবং নসরুল্লাহকে।
পাখি বেগমের মা ফরিদা বেগম বলেন, অগ্নিদগ্ধ অভিযান লঞ্চের স্টাফ কেবিনের ভস্মীভূত ছাইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই মেয়ে পাখি বেগমের ওড়না, অক্ষত কিছু জামাকাপড়, নাতিদের জন্য কেনা জামা প্যান্ট ইত্যাদি। এগুলো আংশিক পোড়া।
দক্ষিণ বড় লবণগোলা গ্রামের নিখোঁজ আব্দুল হাকিমের বাড়িতে গেলে দেখা হয় হাকিম শরীফের অবুঝ তিন সন্তানের সঙ্গে।
এরা হলো- সুমাইয়া (১৪), ফজলুল হক (১০) ও হাফসা বেগম (১৮)। তিনজনই মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার পরীক্ষার ফল জানার পরই হাফসার কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে ওঠে। সেই কান্না থামানো যাচ্ছে না। সমস্ত গ্রামজুড়ে বইছে এখন শোকের ছায়া।